দুর্গা পূজা পূর্ব ভারতের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা এবং বিহারে। এই উৎসবটি দেবী দুর্গার মহিষাসুর নামক অসুরের উপর বিজয়ের পৌরাণিক কাহিনির ভিত্তিতে উদযাপিত হয়। এটি কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গা পূজার উদযাপনের পিছনে মূল কারণগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক, যার মধ্যে রয়েছে পৌরাণিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে আজকের সমাজে এর প্রভাব।
১. পৌরাণিক গুরুত্ব
দুর্গা পূজার মূল কাহিনি প্রাচীন হিন্দু পুরাণ থেকে আসে। মহিষাসুর নামে এক শক্তিশালী অসুর ব্রহ্মার আশীর্বাদে অমরত্ব লাভ করে, যার ফলে কোনো মানুষ বা দেবতা তাকে পরাজিত করতে পারবে না। এই আশীর্বাদ পেয়ে মহিষাসুর স্বর্গ ও পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে, দেবতাদের ক্ষমতা হরণ করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
এই অত্যাচারের মোকাবিলা করতে দেবতারা তাদের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। দশ হাতে নানা দেবতার প্রদত্ত অস্ত্র ধারণ করে এবং সিংহের উপর চড়ে, দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। নয় দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের শেষে, দশম দিনে তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন, যা বিজয়াদশমী বা দশমীর দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দেবী দুর্গার বিজয় এবং মহিষাসুরের পরাজয়ই দুর্গা পূজার মূল কারণ।
২. শক্তির আরাধনা
দুর্গা পূজা “শক্তি” বা দেবী শক্তির পূজা হিসেবে উদযাপিত হয়। হিন্দু ধর্মে “শক্তি” বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিশীল এবং ধ্বংসাত্মক শক্তিকে নির্দেশ করে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের মতো পুরুষ দেবতারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুর্গা হলেন সেই দেবী যিনি এই শক্তিকে ধারণ করেন এবং জগৎকে রক্ষা করেন।
এই পূজা নারীশক্তির গুরুত্বকেও তুলে ধরে, যেখানে নারীকে সৃষ্টিশীল এবং যুদ্ধের শক্তি হিসেবে সম্মান করা হয়। দেবী দুর্গার পূজা নারীর সাহস, ধৈর্য এবং মমতার প্রতীক, যা সমাজে নারীর ভূমিকাকে উজ্জীবিত করে। দুর্গাকে মায়েরূপে (মা দুর্গা) পূজা করা হয়, যেখানে তিনি সুরক্ষক এবং আশীর্বাদদাত্রী হিসেবে আরাধিত হন।
৩. শুভর উপর অশুভের বিজয়
দুর্গা পূজার অন্যতম প্রধান থিম হলো শুভের উপর অশুভের বিজয়, আলোর উপর অন্ধকারের বিজয় এবং ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়। মহিষাসুরের অত্যাচার এবং দেবী দুর্গার দ্বারা তার পরাজয় নৈতিকতার (ধর্ম) এবং বিশৃঙ্খলার (অধর্ম) মধ্যে চলা চিরন্তন যুদ্ধের প্রতীক। দুর্গার বিজয় মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে যতই অশুভ শক্তি শক্তিশালী হোক, তা সর্বদাই শুভের সামনে পরাজিত হবে।
এই উৎসব মানুষকে জীবনযুদ্ধে সাহসী এবং ন্যায়নিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়।
৪. কৃষি ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্ক
দুর্গা পূজা কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। এটি সাধারণত শরতের সময় উদযাপিত হয়, যা ফসল কাটার মৌসুমের সূচনা। দেবী দুর্গার পৃথিবীতে আগমন প্রকৃতির সমৃদ্ধি এবং আশীর্বাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়টি কৃষকদের জন্য নতুন ফসল তোলার সময়, যখন তারা দেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
এই উৎসব ঋতু পরিবর্তনের সময় উদযাপিত হয়, যখন বর্ষাকালের শেষে শরতের সূচনা হয়, প্রকৃতি পুনর্জন্ম লাভ করে এবং চারিদিকে সবুজের ছোঁয়া লাগে।
৫. সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশ
দুর্গা পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশও। কলকাতা এবং অন্যান্য শহরগুলিতে, এটি একটি বৃহত্তর জনসমাবেশের উৎসব, যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে আনন্দ করে। বিভিন্ন পাড়ায় প্যান্ডেল তৈরি করা হয়, যেখানে দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং এটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে মেলবন্ধনের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।
এই সময়ে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হয়, উপহার বিনিময় করা হয় এবং একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা হয়, যা পারস্পরিক ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করে। দুর্গা পূজা ধর্মীয় সীমানাকে ছাড়িয়ে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে একত্রিত করে এবং সামাজিক ঐক্যকে উদযাপন করে।
৬. দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন
দুর্গা পূজার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, বিশ্বাস করা হয় যে দেবী দুর্গা প্রতি বছর তার স্বর্গীয় আবাস থেকে পৃথিবীতে আসেন। পুরাণ অনুযায়ী, দুর্গা হলেন হিমালয়ের কন্যা, এবং প্রতি বছর তিনি তার সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যে আসেন। এই আগমন পারিবারিক উষ্ণতা এবং স্নেহের প্রতীক, যা দুর্গা পূজার আবেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
এই ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক যখন অনেক মানুষ যারা তাদের বাড়ি থেকে দূরে থাকে, এই সময়ে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসে এবং পূজা উদযাপন করে।
৭. আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ ও ভক্তি
দুর্গা পূজা আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ এবং গভীর ভক্তির সময়ও। এই সময়ে মানুষ উপবাস করে, ধ্যান করে এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে আত্মাকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করে। পূজার সময় দেবীর আশীর্বাদ কামনা করে নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
দেবীর মাহাত্ম্য এবং যুদ্ধের কাহিনী “চণ্ডীপাঠ” দ্বারা পাঠ করা হয়, যা ভক্তদের দেবীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করতে সহায়ক।
উপসংহার
দুর্গা পূজা উদযাপিত হয় তার পৌরাণিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে গভীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক কারণে। এই উৎসব ন্যায়ের বিজয়, নারীশক্তির পূজা এবং পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করার পাশাপাশি এই উৎসব মানুষকে ঐক্য, সংস্কৃতি এবং মানবিক মূল্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়।